সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওড়ের
বোয়ালমারা বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়েছিল
পাঁচটি। এদের অনুকূলে অর্থও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর পরও গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত
বাঁধটির কোনো প্রকল্পেরই কাজ শুরু হয়নি।
একই অবস্থা জগন্নাথপুরের নলুয়া হাওড়ের ভুরাখালী
স্লুইস গেটসংলগ্ন বাঁধ এবং হালেয়ার বাঁধেরও। এ দুই বাঁধেও এখন পর্যন্ত কোনো মাটি
ফেলা হয়নি। পুরো জেলায় এ রকম আরো কয়েকটি বাঁধ নির্মাণের কথা ছিল। প্রকল্প
বাস্তবায়নের সময় শেষ হলেও এখন পর্যন্ত সেগুলোর কাজই শুরু হয়নি। সার্বিকভাবে ৯৮৭টি
প্রকল্পের একটিরও কাজ সময়মতো শেষ হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখন
পর্যন্ত এসব বাঁধ নির্মাণের ৬৫ শতাংশের মতো কাজ শেষ হয়েছে। যদিও স্থানীয় কৃষক ও
বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাবি, সার্বিকভাবে এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে
৫০ শতাংশের মতো।
জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ
মাসুম বিল্লাহ জানান, যথাসময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় ১৩টি পিআইসির
সদস্যদের লিখিতভাবে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়েছে। এছাড়া কাজের মেয়াদ আরো ১৫ দিন
বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাব অনুযায়ী,
২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাওড়ের ৬৫ শতাংশ বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ
হয়েছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ সদরে ৮০ শতাংশ, বিশ্বম্ভরপুরে ৫৮, জামালগঞ্জে
৭৫, তাহিরপুরে ৭০, ধর্মপাশায় ৭৫, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে
৭০, দোয়ারাবাজারে ৭০, দিরাইয়ে ৬৫, ছাতকে ৫০,
শাল্লায় ৫০ ও জগন্নাথপুরে ৬৫ শতাংশের কাজ শেষ হয়েছে। অন্যদিকে
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিবেশ ও হাওড় উন্নয়ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এখন
পর্যন্ত বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে ৫৫ শতাংশের কাছাকাছি।
নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় এবারো
হাওড়ের ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কৃষকরা। গত বছর নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণ
না হওয়া ও নির্মাণকাজে অনিয়মের কারণে অকালবন্যায় তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ হাওড়াঞ্চলের
ফসল। গত বছর বৃষ্টি শুরু হয়েছিল মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে। আর শেষ সপ্তাহে শুরু
হওয়া অকালবন্যায় তলিয়ে যায় একের পর এক হাওড়।
হাওড়ে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও ফসলহানির পর
ব্যাপক সমালোচনার মুখে চলতি বছর থেকে বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। চলতি বছর থেকে ঠিকাদারদের বদলে হাওড়ের সব বাঁধের কাজ করছে
স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে গঠিত পিআইসি। এতে কৃষকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে স্থানীয়
প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদেরও। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে
গঠন করা হয়েছে জেলা ও উপজেলা কমিটি। এবার সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলার ৫৩টি হাওড়ে সাড়ে
৫০০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু এবারো নির্ধারিত সময়ে
বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, হাওড়ের পানি
দেরিতে নামায় এবার কাজে বিলম্ব হচ্ছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই সব কাজ শেষ হবে।
অন্যদিকে স্থানীয় কৃষকদের দাবি, পিআইসি
গঠনে বিলম্ব, পাউবো ও উপজেলা প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা
এবং জনপ্রতিনিধিদের পছন্দের লোকদের পিআইসিতে অন্তর্ভুক্তির কারণে বাঁধের কাজে দেরি
হচ্ছে। শেষ সময়ে এসে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিম্নমানের কাজ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ
তুলেছেন তারা।
নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় কৃষকরা
এখন ক্ষুব্ধ। তাহিরপুরের লেদারবন্দ হাওড়সংশ্লিষ্ট কৃষকরা এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে
বিক্ষোভও করেছেন।
তাহিরপুরের বড়দল এলাকার কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন,
সময় শেষ হওয়ার পর তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এখন কাজ খুবই নিম্নমানের হচ্ছে।
বাঁধের নিচ থেকেই মাটি কেটে বাঁধে দেয়া হচ্ছে। আর শেষ সময়ে কাজ হওয়ায় মাটি
শক্তভাবে বসার সুযোগ পাবে না। ফলে বৃষ্টি হলেই বাঁধের মাটি পানিতে মিশে যাবে।
প্রসঙ্গত, দেশের নিচু
এলাকাগুলোর অন্যতম হচ্ছে হাওড়াঞ্চল। দেশে মোট বোরো আবাদের বৃহদাংশের চাষ হয়
এখানেই। সিলেট জেলা ও তত্সংলগ্ন এলাকায় প্রতি বছর মার্চের দিকে এসে প্রচুর
বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টি হয় সীমান্তের ওপারের ভারতের মেঘালয় পাহাড়েও। মেঘালয়ের এ
পাহাড়ি ঢল হাওড়ের দিকে নেমে আসে মার্চ-এপ্রিলের দিকে। ফলে এ সময় বন্যার
প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বন্যার হাত থেকে হাওড়াঞ্চলের উৎপাদিত ফসল রক্ষার জন্য নির্মাণ
করা হয় উঁচু বাঁধ। কিন্তু প্রতি বছরই এসব বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ
ওঠে। বাঁধ নির্মাণে গাফিলতির কারণে ফি বছরই তলিয়ে যায় হাওড়ের ফসল, যা
গত বছর ভয়াবহ রূপ নেয়।
সরকারি হিসাবেই গত বছর ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪
হাওড়ের বোরো ফসল তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল।
অন্যদিকে কৃষকদের হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ।
জগন্নাথপুরের নলুয়া হাওড় এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে
দেখা যায়, এখানকার ভুরাখালী স্লুুইস গেটসংলগ্ন বাঁধ ও হালেয়ার পতিত বাঁধে মাটিই
পড়েনি। বৈশাখী বাঁধের কিছু অংশে মাটির কাজ চলছে। গত বছর প্রথম এ বাঁধ ভেঙেই হাওড়ে
পানি প্রবেশ করেছিল বলে স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন। এখানকার স্থানীয় কৃষক আব্দুর
রউফ বলেন, এখনো হাওড়ের বাঁধগুলোর কাজ শেষ না হওয়ায় আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। গতবার
ফসল গেছে, এবারো যদি ফসল তুলতে না পারি, তাহলে না খেয়েই
মরতে হবে।
পরিবেশ ও হাওড় উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির
রেজা বলেন, আমাদের জরিপ অনুযায়ী এখন পর্যন্ত গড়ে ৫২ শতাংশ
বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে। এ বছর বাঁধের
কাজ অনেক আগে শেষ করা উচিত ছিল। কারণ প্রকৃতি
কখন বিরূপ হবে তার যেমন ঠিক নেই, তেমনি বাঁধ শক্ত হওয়ার জন্যও কিছুটা
সময় দরকার।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সুনামগঞ্জের নির্বাহী
প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া বলেন, এখন পর্যন্ত ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
বাকি কাজ আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, সব উপজেলায় এখন
মূলত চলছে শেষ দিককার কাজ; যেমন মাটি সমান করা, দুরমুশ
করা, ঘাস লাগানোর কাজ বাকি আছে। এবার সবকিছু আগাম পরিকল্পনা করলেও হাওড়ে
জলাবদ্ধতা থাকায় বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হতে দেরি হয়, এ কারণে কাজ শেষ
করতেও কিছু সময় বেশি লাগছে।
কিছু প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু না হওয়া প্রসঙ্গে
তিনি বলেন, সব প্রকল্পের কাজই শুরু হয়ে গেছে। এবার
প্রকল্পগুলো অনেক বড়। ফলে একদিকে শুরু হলে আরেকদিকে দেখা যাচ্ছে না।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জের ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর
জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। গত বছর আবাদ হয়েছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫ হেক্টরে।
নেত্রকোনায়ও শেষ হয়নি কাজ: নির্ধারিত সময়
পেরিয়ে গেলেও নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলের ফসল রক্ষা প্রকল্পের নির্মাণকাজ ৭৫ থেকে ৮০
শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে আশঙ্কা থেকে গেছে সেখানকার স্থানীয় কৃষকদের মধ্যেও।
নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় ক্ষুব্ধ
প্রতিক্রিয়া এসেছে জেলা কাবিটা স্কিম মনিটরিং কমিটির সভায়। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন,
আগামী সাতদিনে শতভাগ কাজ শেষ করা হবে।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী
প্রকৌশলী মো. আকতারুজ্জামান বলেন, নেত্রকোনা জেলার হাওড়াঞ্চলে প্রায় ৩৩০
কিলোমিটার ছোট-বড় বাঁধ রয়েছে। তার মধ্যে অতিগুরুত্বপূর্ণ ফসল রক্ষা বাঁধ হিসেবে এ
বছর ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ে ৭৫
থেকে ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ স্বল্প সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা রাখছি।
No comments:
Post a Comment