গাজীপুরের শ্রীপুর জৈনাবাজার
গাজীপুরের শ্রীপুরের জৈনাবাজারে ইজারার কাগজ দেখিয়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও দোকানপাট।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাড় ঘেঁষে গাজীপুরের শ্রীপুরের জৈনাবাজারে টিন দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বড় একটি ঘর। ঘরের সঙ্গেই লম্বা একটি বাঁশের মাথায় উড়ছে জাতীয় পতাকা। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের জায়গায় গড়ে তোলা ওই ঘরের বাইরে 'বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যালয় গাজীপুর ইউনিয়ন শাখা' লেখাযুক্ত একটি সাইনবোর্ড টাঙানো আছে। এ ব্যাপারে স্থানীয়দের অভিযোগ, এটা আওয়ামী লীগের কার্যালয় নয়। মূলত সাইনবোর্ড টাঙিয়ে জমি জবরদখল করে রাখা হয়েছে। মহাসড়কের দুই পাশে সওজের প্রায় এক কি.মি. জায়গাজুড়ে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে আরও অন্তত ২০০ দোকান। এসব দোকান থেকে আদায় করা লাখ লাখ টাকা চাঁদা ওই 'কার্যালয়ে' বসে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। সাধারণত রাত ১০টার পর এ বাটোয়ারা চলে। জায়গা বরাদ্দ দিয়ে দোকানিদের কাছ থেকে আদায় করা জামানতও ছাড়িয়ে গেছে কোটি টাকা।
স্থানীয়দের এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সমকালের অনুসন্ধানেও বেরিয়ে আসে চাঁদা আদায়ের নানা কৌশল। অনুসারীদের নিয়ে দিনের পর দিন অবৈধ এ কাজ করে চলেছেন গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া আবুল হাশেম। যদিও অভিযুক্ত আবুল হাশেম আদায় করা টাকাকে চাঁদা বলতে নারাজ। তিনি দাবি করেছেন, সরকারের কাছ থেকে ৬০ লাখ টাকায় এ বাজার ইজারা নিয়ে খাজনা আদায় করছেন। আর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যালয় গড়ে তোলার ব্যাপারে একে অপরের ওপর দায় চাপিয়েছেন আবুল হাশেম ও সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাড় ঘেঁষা সওজের প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা দখল করে ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন দোকান। সেখানে সেলুন, কাপড়, মাছ-মাংস, শুঁটকি, কাঁচাবাজার সবই আছে। স্থাপন করা হয়েছে পানি তোলার বৈদ্যুতিক মোটর।
সওজের জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেন এমন দোকানিরা জানান, তারা এই জায়গা দখল করেননি। জৈনাবাজারের ইজারাদার আবুল হাশেম ও তার লোকজন অফেরতযোগ্য জামানত নিয়ে এসব ঘর করে দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাপড় ব্যবসায়ী জানান, সাড়ে ৩ লাখ টাকা জামানত দেওয়ার পর তাকে ছোট্ট একটি ঘর দেওয়া হয়েছে। প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা ভাড়াও দেন।
শরিফুল ইসলাম নামে মাংস ব্যবসায়ী জানান, জবাই করা প্রতি গরুর জন্য ৮০০ টাকা দিতে হয়। এই টাকা কেন দিতে হয়? উত্তরে বলেন, খাজনা হিসেবে আবুল হাশেমের লোকজন এই টাকা নেয়।
সবজি ব্যবসায়ী হাফিজ উদ্দিন বলেন, ৩৫ হাজার টাকা জামানত দিয়েছি। প্রতিদিন ৪০০ টাকা দিতে হয় হাশেম সাহেবের লোকজনকে। মাছ ব্যবসায়ী কবীর জানান, প্রতিদিন ৪০০ টাকা দিতে হয়।
মহাসড়কের পাশে বসে লাউ বিক্রি করছিলেন কামাল নামে কৃষক। তিনি বলেন, ৩টি লাউ নিয়ে বাজারে এসেছি। ৯০ টাকা বিক্রি করেছি। এর পর এক লোক এসে 'খাজনা' হিসেবে ৩০ টাকা নিয়ে গেছে।
সওজের জায়গায় গড়ে তোলা জৈনাবাজারের প্রত্যেক দোকান থেকে সর্বনিম্ন ২০০ টাকা নেওয়া হয় প্রতিদিন। সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা। এই হিসাবে প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ টাকা চাঁদা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।
স্থানীয় লোকজন ও ব্যবসায়ীরা জানান, নীতিহীন এসব কাজের প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয় না। ফলে তারা আর প্রতিবাদ করেন না। তারা বলেন, ইজারার একটি কাগজ দেখিয়েই এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকাশ্যে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে আবুল হাশেম বলেন, চলতি বছরের জন্য ৬০ লাখ টাকায় জৈনাবাজার ইজারা নিয়েছি। ঐতিহ্যবাহী এ বাজারের নির্ধারিত কোনো জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে সওজের জায়গায় বাজার বসে। দোকানিদের কাছ থেকে চাঁদা নয়; খাজনা আদায় করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।
জামানত নেওয়া প্রসঙ্গে হাশেম বলেন, কারও কাছ থেকে জামানত নেওয়া হয়নি। দোকানিরাই নিজেদের খরচে ঘর করে ব্যবসা করছেন। তার দাবি, যেহেতু সরকার এই বাজার ইজারা দিয়ে প্রতি বছর অর্ধ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব নিচ্ছে, তাই জৈনাবাজারের জন্য একটি নির্ধারিত স্থান বরাদ্দ প্রয়োজন।
সওজের জায়গায় আওয়ামী লীগের কার্যালয় গড়ে তোলা প্রসঙ্গে তার দাবি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ঘরটি করেছেন। এটি দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে গাজীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বলেন, নির্বাচনের আগে এখানে একটি নৌকা প্রতীকের ক্যাম্প করা হয়েছিল। কিন্তু ঘরটি যে পরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিজেই জানি না।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, ইজারা দেওয়া জায়গা থেকে সরকার একটা রাজস্ব পায়। কিন্তু সেখানে ঘর তুলে ভাড়া দেওয়া কিংবা হস্তান্তর করা যাবে না। নিয়মবহির্ভূতভাবে যদি এমনটা কেউ করে, তাহলে খুব শিগগিরই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাওনা হাইওয়ে থানার ওসি দেলোয়ার হুসেন বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। দু'একদিনের মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হতে পারে।
- কার্টসিঃ সমকাল/ জানু ১৪, ২০১৯
No comments:
Post a Comment