কয়েক মাস স্থিতিশীল থাকার পর হঠাৎ চালের দামে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। গত দু-একদিনে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩ থেকে ৫ টাকা। অথচ এখন আমন ধানের মৌসুম চলছে। পাশাপাশি প্যাকেটজাত আটা ও ময়দার দামও কেজিতে ২ টাকা বেড়েছে। ভরা মৌসুমে চালের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। অন্যদিকে দাম বৃদ্ধির কারণে বেকায়দায় পড়েছেন নিম্ন-আয়ের মানুষ। রাজধানীর কয়েকটি বাজারের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, গত কয়েক দিনে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। আর মিল মালিকদের দাবি, চালের দাম এত দিন কম ছিল। ফলে কৃষক ধানের ভালো দাম পাচ্ছিলেন না।
গম আমদানিকারক ও আটা বিপণনকারীদের দাবি, বিশ্ববাজারে গমের দাম বেশ বেড়েছে। সে অনুপাতে দেশে আটার দাম বাড়েনি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কায়েক দিনের ব্যবধানে মিল পর্যায়ে চালের দাম বেড়েছে বস্তায় (৫০ কেজি) ২১০-২৫০ টাকা বা মণপ্রতি ১৫৮-১৮৭ টাকা। মিল পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পাইকারিতে পুরোপুরি পড়তে আরো কিছুটা সময় লাগবে। তার পরও এরই মধ্যে পাইকারিতে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম ১২০-১৪৫ বা মণপ্রতি ৯০-১১০ টাকা বেড়েছে। আর খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে কেজিতে ৪ টাকা পর্যন্ত।
ব্যবসায়ীরা জানান, জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকে ধানের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে সরকারিভাবে চাল ক্রয় করায় বাজারে চালের দাম বাড়ছে। এর ফলে গত তিন দিনে কেজিতে মোটা চাল ৪ টাকা, সরু চাল ৩ টাকা ও সুগন্ধি চাল ৫ টাকা বেড়েছে। বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল স্বর্ণা ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, বিআর-২৮ ও লতা ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, মিনিকেট ৫২ থেকে ৫৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভালো মানের সুগন্ধি চাল ১০০ টাকা ও সাধারণ মানের সুগন্ধি চাল ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া নতুন আমন ৩৭ থেকে বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে।
পাশাপাশি কেজিতে ২ টাকা বেড়ে ২ কেজির প্রতি প্যাকেটের নতুন মূল্য আটা ৬৮ টাকা ও ময়দা ৯২ টাকা হয়েছে। এক সপ্তাহ আগেও আগের নির্ধারিত দরের চেয়ে কেজিতে ২-৩ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে। এ হিসাবে আটা-ময়দার দাম কেজিতে প্রায় ৫ টাকা বেড়েছে বলে দাবি করেছেন দোকানিরা।
রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোয় মানভেদে প্রতি কেজি উন্নত মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮-৬২, সাধারণ মানের ৫৪-৫৮, মাঝারি মানের ৪৪-৫২ ও মোটা চাল প্রতি কেজি ৩৮-৪২ টাকায়। কয়েক দিন আগেও এসব চাল কেজিপ্রতি ৩-৪ টাকা কমে বিক্রি হয়েছিল।
কাওরান বাজারের খুচরা দোকানে ভালো মানের সরু মিনিকেট চাল কেজিপ্রতি ৫৫-৫৬ টাকা, মাঝারি বিভিন্ন চাল ৪৪-৪৮ টাকা এবং মোটা গুটি ও স্বর্ণা চাল ৩৭-৩৮ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায়।
কাওরান বাজারের হাজি রাইস এজেন্সির মালিক মানিক বলেন, মিলমালিকরা গত কয়েক দিনে সব ধরনের চালের দাম বস্তায় (৫০ কেজি) ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। এ কারণে পাইকারি আড়তে দাম বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সুগন্ধি চালের দাম। প্রতি বস্তায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। তিনি বলেন, এবার উৎপাদন ভালো থাকায় পর্যাপ্ত চালের মজুদ আছে। এখন যৌক্তিক কারণ ছাড়াই মিলমালিকরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সপ্তাহের ব্যবধানে বোরো সরু চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪ টাকা। আর কেজিপ্রতি ২ টাকা বেড়েছে বোরো মাঝারি চালের দাম। গত সপ্তাহে বোরো সরু চাল প্রতি কেজি ৫২ টাকায় বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে কিনতে হচ্ছে ৫৬ টাকায়। একইভাবে ৪০ টাকা কেজি দরের বোরো মাঝারি চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকায়।
মিলমালিকরা দাবি করছেন, সরকারি খাদ্যগুদামে আমন মৌসুমের ধান ও চাল ক্রয় করা শুরু হয়েছে। এর কারণে বাজারে চালের দাম বেড়েছে। তাছাড়া এ বছর কৃষক ও এলাকার মহাজন ব্যবসায়ীরা ধান বিক্রি না করায় বাজারে দাম বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ অটো-মেজর ও হাসকিং রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, চালের দাম অনেক দিন বাড়েনি। এখন আমন মৌসুম হলেও সরকার কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দিতে ধান কিনছে। এতে মিল মালিকদের বাড়তি দামে ধান কিনতে হচ্ছে। সে কারণে চালের দামও বেড়েছে। তিনি আশা করেন, কৃষক ও ট্রেডিং ব্যবসায়ীদের হাতে মজুদ ধান ও চাল বাজারে ছাড়লে দাম খুব বেশি বাড়বে না, স্থিতিশীল হবে।
কাওরান বাজারে বাজার করতে আসা আহসান হাবিব বলেন, যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই চালের দাম বাড়ছে। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন পাইকারি ও মিলমালিকদের। তিনি বলেন, নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগেই সুযোগ নিয়েছেন মিলমালিকরা। এই সময়ে সরকারের সঠিক মনিটরিং না থাকায় আমন মৌসুমে চালের দাম তারা যে যেভাবে পারছেন, বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, নির্বাচনের তিন দিন আগে পরিবহন ব্যবস্থায় কড়াকড়ির কথা বলে চাল সরবরাহ বন্ধ রেখেছিলেন মিলাররা। নির্বাচনের পর চাল সরবরাহ শুরু হলেও মিলগুলো থেকেই প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) দুই ধাপে ১০০ টাকা করে দাম বাড়ানো হয়েছে।
পুরান ঢাকার বাবুবাজার-বাদামতলীর চালের আড়ত মালিকেরা জানান, প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চালের দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে। মোটা চালের পাইকারি দর উঠেছে কেজিপ্রতি ৩৫ টাকার আশপাশে। অন্যদিকে মাঝারি চাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে কেজিপ্রতি ৩৮-৪২ টাকায়। এ ছাড়া ভালো মানের সরু মিনিকেট চাল কেজিপ্রতি ৫২-৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাদামতলীর চালের আড়ত শিল্পী রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী কাওসার রহমান বলেন, ভোটের কয়েক দিন আগে ও পরে মিলিয়ে চালের দামটা কিছুটা বাড়ল। মোটা চাল কেজিপ্রতি ৩২-৩৩ টাকায় নেমে গিয়েছিল যা ২০১৭ সালের শেষ দিকে কেজিপ্রতি ৪৫ টাকার বেশি ছিল।
গত ডিসেম্বর থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চাল সংগ্রহ শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, এবার আমন চালের উৎপাদন খরচ পড়েছে সাড়ে ৩৪ টাকা। বাজার পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে, খোঁজ-খবর নিয়ে মূল্য ৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এর আগে চালের দামের সবচেয়ে অস্বস্তিকর সময় ছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস। ওই সময় খুচরা বাজারে মোটা চালের দর কেজিপ্রতি ৫০ টাকায় উঠেছিল। আর সরু চাল উঠেছিল কেজিপ্রতি ৭০ টাকায়। পরে নতুন ধান ওঠায় চালের দাম কমে আসে।
- কার্টসিঃ মানবজমিন/ জানুয়ারী ৬,২০১৮
No comments:
Post a Comment