সম্পাদকীয়
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ডাকসু নির্বাচনের ওপর বিধিনিষেধ উঠে যাওয়া একটি ভালো অগ্রগতি। সেই হিসাবে আগামী মার্চের মধ্যে এই নির্বাচন হতে হবে বলেই ধরা যায়।
কিন্তু সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন থেকে আজকের প্রেক্ষাপটের তুলনা করলে মানতে হবে যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিশেষ করে সেই পরিবর্তনের প্রভাবে ক্যাম্পাসের চিরচেনা ‘ছাত্ররাজনীতি’ আমূল পাল্টে গেছে। নব্বইয়ের গণ–আন্দোলনে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর ছাত্ররাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা জরুরি মনে করা হলেও এর সংজ্ঞায় পরিবর্তনের দাবি উঠেছিল। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে নির্বাচনী আইনে প্রধান দলগুলো এই বিধান অন্তত কাগজে-কলমে মেনেছে যে ছাত্রসংগঠনগুলো এখন আর ‘অঙ্গ’ নয়, ‘সহযোগী’ সংগঠন। তবে বাস্তবে এই পরিবর্তনের কোনো প্রভাব দেখা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রসংগঠনগুলোকে আগের মতোই মূল দলের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে অথবা ছাত্রসংগঠনগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে গায়েবি মামলায় দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি যেভাবে জাতীয় রাজনীতিতে জেরবার, সেভাবেই বিরোধী দল সমর্থিত ছাত্রসংগঠনগুলোও ক্যাম্পাসে কোণঠাসা।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং মহাজোটের শরিক দলের সমর্থিত ছাত্রসংগঠনগুলো ছাড়া ছাত্রদল এবং অধিকাংশ বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি ও পরিবেশ ডাকসু নির্বাচনের জন্য অনুকূল আছে বলে মনে করে না। নব্বই সালে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে এই নির্বাচনটি ঝুলে ছিল। এর সপক্ষে বহু দাবিদাওয়া জানানো হয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা বিবেচনায় নেয়নি। সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের পর এখন এই নির্বাচন অনুষ্ঠান একটি বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনকে অর্থপূর্ণ করার অন্যতম শর্ত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নির্বাচিত ছাত্রপ্রতিনিধির অংশগ্রহণ। কিন্তু আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করে চলেছি যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বায়ত্তশাসনের ধারণায় ব্যাপক ধস নেমেছে। সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধিদের নির্বাচন নিয়েও নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। সুতরাং বহুপ্রতীক্ষিত ডাকসু নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটা উদ্বেগজনক যে বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো অব্যাহতভাবে বলছে যে ডাকসু নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নেই। এর সপক্ষে তাদের বক্তব্য হচ্ছে যে সবগুলো আবাসিক হলের নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের হাতে। সেখানে আর কারও কিছু করার সুযোগ নেই। তাদের দাবি, ছাত্রছাত্রীদের কে কোন কক্ষে থাকবে, সেটি পর্যন্ত ছাত্রলীগ নির্ধারণ করে দেয়।
এমন অভিযোগ ছাত্রলীগ অস্বীকার করলেও বাস্তবতা এটাই যে ছাত্রদল সমর্থিত নেতা-কর্মীদের ক্যাম্পাসে উপস্থিতি খুবই কম। এবং তাদের কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা নেই বললেই চলে। এমনকি সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ছাত্রদল ও তার সমর্থকেরা ক্যাম্পাসে চা খেতে এসেও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন।
জাতীয় রাজনীতিতে নির্বাচনের আগে যেমন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল না, এ ক্ষেত্রেও সেই একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে আমরা অব্যাহতভাবে নির্বাচনের মাঠ সমতল কারার কথা বলে এসেছি। ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখেও আমরা সেই একই দাবি জানাতে চাই। সব ছাত্রসংগঠন যাতে ক্যাম্পাসে সমভাবে তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারে, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আশা করব দীর্ঘ বিরতির পর যে ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তা উৎসবমুখর পরিবেশে সবার অংশগ্রহণে ও কোনো রকম অনিয়ম ছাড়াই অনুষ্ঠিত হবে।
- কার্টসিঃ প্রথম আল/জানু ৯, ২০১৯
No comments:
Post a Comment