Search

Thursday, September 13, 2018

তাঁরা ককটেল দেখেননি, তবুও সাক্ষী


পুলিশের কাজে বাধা ও হামলার অভিযোগে ৩ সেপ্টেম্বর পল্টন থানার পুলিশ একটি মামলা করে। এতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। 

পুলিশ দাবি করছে, ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডের পূর্ব মাথায় ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তায় যান চলাচলে বাধা দেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। একপর্যায়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে তাঁরা হামলা করেন। তাঁদের ইটের আঘাতে পুলিশের দুজন কর্মকর্তাসহ পাঁচজন সদস্য আঘাত পান। সেখান থেকে উদ্ধার দেখানো হয় জর্দার কৌটার তিনটি অংশ।

পুলিশ বলছে, ইব্রাহীম মোল্লা নামের এক ব্যক্তির সামনে থেকে জর্দার কৌটা উদ্ধার করা হয়। তাঁকে করা হয় জব্দ তালিকার সাক্ষী। অবশ্য ইব্রাহীম প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ তাঁর নাম-ঠিকানা লিখে নিয়েছিল। কিন্তু কোনো জর্দার কৌটা তিনি দেখেননি। 

জব্দ তালিকা প্রস্তুতকারী কর্মকর্তা পল্টন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সৈয়দ আলী বলেন, গন্ডগোল শেষ হওয়ার পর জর্দার কৌটা জব্দ করা হয়। তখন হয়তো ইব্রাহীম তা দেখেননি।পল্টন থানার এ মামলার মতো রাজধানীর ৩২ থানায় এমন মামলা আরও হয়েছে ১ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে কয়েকটি মামলার জব্দ তালিকার সাক্ষীরা বলেছেন, তাঁদের সামনে থেকে কোনো কিছু জব্দ করতে তাঁরা দেখেননি। পুলিশ শুধু তাঁদের নাম-ঠিকানা ও স্বাক্ষর নিয়েছিল।

১ সেপ্টেম্বর ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এরপর থেকেই বিএনপি ও এর অঙ্গ–সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নামে নতুন নতুন মামলা দিচ্ছে পুলিশ। ধরপাকড়ও শুরু করেছে। পুলিশ বলছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কয়েক দিনে রাস্তা অবরোধ করছেন। বাধা দিলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা করছেন। ককটেল ছুড়ে পুলিশ সদস্যদের গুরুতর আহত করছেন।

ঢাকার আদালত, পুলিশ ও বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ দিনে ঢাকা মহানগরের ৩২টি থানায় পুলিশ বাদী হয়ে বিএনপি ও এর অঙ্গ–সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নামে ৮৬টি মামলা করেছে। গ্রেপ্তার করেছে ১৬৯ জনকে। এর মধ্যে গত সোমবারই গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭১ জনকে।

বেশির ভাগ মামলা করা হয়েছে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার কারণে দণ্ডবিধিতে, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক আইনে, যা অজামিনযোগ্য। এসব মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসামি করা হচ্ছে ঢাকা মহানগরের থানা ও ওয়ার্ড কমিটির নেতাদের নাম উল্লেখ করে। 

পল্টন থানার বিএনপির সভাপতি আদিল খান বাবুকে আসামি করে বিএনপির ৪৩ জনের নাম উল্লেখ করে মতিঝিল থানায় আরেকটি মামলা করেছে পুলিশ। মামলায় পুলিশ দাবি করছে, ৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা মধুমিতা সিনেমা হলের সামনে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেন। এ সময় পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে। আসামিদের আঘাতে পুলিশের তিনজন সদস্য আহত হন। রাস্তার বেশ কয়েকটি বাস ভাঙচুর করেন আসামিরা। বাঁশের লাঠিসহ দুটি ক্রিকেট খেলার স্টাম্প জব্দ দেখিয়েছে পুলিশ।

জব্দ তালিকার সাক্ষী মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি রাস্তার ফুটপাতের দোকানদার। সেদিন কোনো ঘটনা তিনি সেখানে ঘটতে দেখেননি। 

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সাত্তারসহ বিএনপির ১৫ জন নেতার নাম উল্লেখ করে বিস্ফোরক আইনে মামলা করেছে পুলিশ। পুলিশ দাবি করছে, ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে সূত্রাপুরের হাজী আবদুল মজিদ লেনের হক মটরসের সামনে বেলা দেড়টার দিকে মিছিল নিয়ে সরকারবিরোধী স্লোগান দেয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। চার টুকরা জর্দার কৌটার অংশ জব্দ দেখিয়েছে পুলিশ। 

আবদুস সাত্তারসহ বিএনপির ১৬ জন নেতা-কর্মী সূত্রাপুরের জনসন রোডে জাকির ফার্মেসির সামনে ৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার দিকে পুলিশের কাজে বাধা ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটিয়েছেন বলে মামলা করে পুলিশ। এ মামলাটিও বিস্ফোরক আইনে করা।

জব্দ তালিকার সাক্ষী ফজলে রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, কোন জায়গা থেকে ককটেল জব্দ করা হয়েছে, তা তিনি দেখেননি। তবে জব্দ তালিকা প্রস্তুতকারী কর্মকর্তা সূত্রাপুর থানার এসআই নাজমুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে। 

সূত্রাপুর থানা-পুলিশ দাবি করছে, ৩ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টার দিকে রায় সাহেব বাজার মোড়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সাত্তারসহ বিএনপির ১৬ জন নেতা-কর্মী পুলিশের ওপর হামলা করেন। মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান। অবিস্ফোরিত ককটেল উদ্ধার দেখানো হয়েছে।

আদালতকে পুলিশ জানিয়েছে, পাবলিক সাক্ষী রবিনের সামনে থেকে এসব ককটেল জব্দ করা হয়। অথচ রবিন প্রথম আলোকে বলছেন, তিনি কোনো ককটেল দেখেননি। রায় সাহেব বাজারে সেদিন কোনো ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে কি না, তা-ও তিনি জানেন না। সূত্রাপুরে রবিনের মোবাইল সার্ভিসিংয়ের একটি দোকান আছে।

মামলাই হচ্ছে কেবল, আটক কম 

রাজধানীর সূত্রাপুর, ওয়ারী ও গেন্ডারিয়া থানায় গত ১২ দিনে মামলা হয়েছে ১১টি। সূত্রাপুর থানায় হয়েছে ৮টি। কিন্তু কোনো আসামি গ্রেপ্তার হননি। সূত্রাপুর থানার ৮ মামলার মধ্যে ১টিতে পুলিশ বলেছে, ৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে সূত্রাপুরের কাজী আবদুর রউফ রোডের গোডাউনের সামনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে ১৮ জন নেতা-কর্মী পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা করেন। ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটান। তবে এই মামলায় কেউ গ্রেপ্তার হননি। 

একইভাবে সূত্রাপুর থানার আরেকটি মামলায় পুলিশ দাবি করে, বিএনপির নেতা সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার কাজী আবুল বাশারসহ ৯৫ জন নেতা-কর্মী ৩ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে আর কে মিশন রোডের বাংলাদেশ বয়েজ ক্লাবের মাঠের কাছে একত্র হন। সরকার উৎখাতের জন্য সেখানে বসে ষড়যন্ত্র করে। এ মামলায়ও কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। 

সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম আশরাফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। 

বিএনপির নেতা-কর্মীদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদিন মেজবাহ প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ করে ঢাকা মহানগর পুলিশ থানায় থানায় নতুন মামলা করছে। আসামি করছে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের। এর ফলে বেশির ভাগ নেতা-কর্মী এলাকাছাড়া।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রথম আলোকে বলেন, নতুন করে পুলিশ যেসব মামলা করেছে, তা হাস্যকর। কোনো ঘটনাই ঘটেনি অথচ থানায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের যত নেতা আছেন, সবাইকে আসামি করা হচ্ছে। এর আগে এমন মামলা কেউ দেখেনি। নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতা-কর্মীদের নামে সাজানো মামলা দেওয়া হচ্ছে।

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও গণসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোথাও যদি আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটিত হয়, এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার পর পুলিশ সেখানে মামলা নিতে বাধ্য। কাউকে হয়রানির উদ্দেশ্যে কোনো মামলা হচ্ছে না।’

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ১৩,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment