Search

Sunday, April 1, 2018

'উন্নয়নশীল’ দেশ স্বীকৃতি এবং বাস্তবতা

অধ্যাপক সারওয়ার মো. সাইফুল্লাহ্ খালেদ


১৯৬০-এর দশকের শেষার্ধে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স করাচিতে স্টাফ ইকোনমিস্ট ছিলাম। তখন দেখেছি, এই ইনস্টিটিউটের বিদেশী রিসার্চ অ্যাডভাইজারেরা মাঝে মধ্যে তাদের বাসায় সন্ধ্যায় গার্ডেন পার্টি দিতেন। সেখানে যাওয়ার একাধিকদাওয়াত পেয়েছি এবং গিয়েছি।

একবার এক পার্টিতে নুরুন্নবী নামে এক স্টাফ ইকোনমিস্ট যিনি শিগগিরই ফোর্ড ফাউন্ডেশনের স্কলারশিপে আমেরিকা পিএইচডি করতে যাবেন, তার বোতামখোলা কোটের বোতাম নিজ হাতেই লাগিয়ে দিতে দিতে এক মার্কিন রিসার্চ অ্যাডভাইজার বললেন- ‘জেন্টেলম্যান, ইফ ইউওয়ান্ট টু গো টু অ্যামেরিকা ইউ আর টু বাটোন ইউর কোট’। কথাটি স্মরণ করলাম এ কারণে যে, বাংলাদেশ সম্প্রতি ‘স্বল্পোন্নত’ দেশ থেকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশে উত্তরণের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃতি পেয়েছে। আমেরিকা যেতে হলে যেমন পরিধানের কোট‘বাটোন্ড’ করতে হয়, তেমনি স্বল্পোন্নত দেশকে উন্নয়নশীল দেশ হতেও এমন কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়, যাতে সার্টিফিকেট প্রদানকারী পশ্চিমা দেশ বা তাদের সমর্থনপুষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে খুশি করা যায়।

বর্তমান বাংলাদেশে সমস্যার অন্ত নেই। দেশে শিক্ষার এমনই দুর্দশা যে, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক উভয়ই হতাশ। ফলে বিত্তশালী এবং সচ্ছল পরিবারগুলো ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়ালেখা শেখাচ্ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারদলীয় ছাত্রদের একছত্র দখলেই শুধু নয়, তাদেরঅনৈতিক তাণ্ডবে অচল হয়ে গেছে। সেখানে দলীয় রাজনীতি এত বেশি প্রবেশ করেছে যে, সরকারদলীয় ছাত্রদের বাইরের অন্য ছাত্ররা ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত প্রায়। শিক্ষকদের মধ্যে ছাত্রদের মতোই দলাদলি হাতাহাতি। দেশে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এত এগিয়েছে যে,সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বল্পবিত্তের পরিবারগুলোর সন্তানদের পড়ালেখা প্রায় লাটে উঠেছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এমন যে, কারো কারো মতে- দেশে মূর্খায়নের প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। বিদ্যমান শিক্ষার পরিবেশ ও ব্যবস্থা মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্তরায়। অদূরভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার মতোসুশিক্ষিত লোক দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জোগান দিতে পারবে না। অর্থমন্ত্রীর মতে, শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে না পারলে অর্থনৈতিক অর্জন বিফলে যাবে।

অবকাঠামো খাতে রাস্তাঘাটের অবস্থার বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় খারাপ দেশ। দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় বিপুল লোক মারা যায়। দেশের অভ্যন্তরে স্বাস্থ্যসেবার অনিয়ম ও নিম্নমানের কারণে সচ্ছল লোকজন চিকিৎসার জন্য পাশের দেশ বা অন্য কোনো দেশে পাড়িজমান। গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকেরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতেও বিদেশে ছোটেন। দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। দেশের সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলছেন, ‘এ খাতে পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি হচ্ছে’। উজানের দেশ ভারতএকতরফা পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় দেশের নদ-নদী-খাল-বিলগুলো পানিশূন্য হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে দেশের রাজধানী ও অন্যান্য শহরগুলো দিন দিন অনাবাসযোগ্য হয়ে পড়ছে। বাড়ছে বহুতল দালান কোঠা; ঘিঞ্জি শহরÑ এর মাঝে মানুষ কীট।যানজট, জনজট, জলজটসহ নানাবিধ সমস্যায় দেশের প্রধান নগরগুলো বিপর্যস্ত। জনজীবনে নানাবিধ দুঃসহ দুর্ভোগ। এ তালিকার শেষ নেই; সংবাদপত্রের পাতা উল্টালে বা টেলিভিশন খুললেই নিত্যদিন এসব চোখে পড়ে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। গুম, খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, সংঘর্ষ, রাহাজানি, মাদকের আগ্রাসন প্রভৃতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রভাবশালী মহল প্রতিনিয়ত নদী, খাল, বিল দখল করে দেশকে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিদিনএ সব বিষয় জাতীয় মিডিয়ায় চোখে পড়ে। উদীয়মান পোশাক শিল্পে একমাত্র নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের বাদ দিলে এর ওপর যারা কর্মরত তাদের বেশির ভাগ বিদেশী। বছরে প্রায় ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার এদেশে কর্মরত কেবল ভারতীয়রাই নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে প্রায় ১৫লাখ ভারতীয় নাগরিক বৈধ-অবৈধ উপায়ে কাজ করছেন। অথচ দেশে বেকারের সংখ্যা ৭৩ লাখের কাছাকাছি। বিদেশী ঋণে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, তার ব্যয়ের বেশির ভাগ সেসব প্রকল্পের বিদেশী পরামর্শকদের পকেটে যায়। অথচ সে ঋণের বোঝা দেশের সাধারণনাগরিকদের টানতে হয়। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। বিত্তশালীরা বিদেশে ‘সেকেন্ড হোম’ বানিয়ে দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এতসব নেতিবাচক বিষয়ের পরও বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার মতো কিছু কাজ আছে। সরকার ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে চোখ ধাঁধানো ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে এবং আরো করছে। ঢাকায় হচ্ছে মেট্রোরেল। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর নিচদিয়ে টানেল নির্মিত হবে। সময়ের সাথে ক্রমবর্ধমান নিজ খরচে বিদেশী কলাকুশলীদের সহায়তায় পদ্মা নদীর ওপর দেশের দীর্ঘতম সেতু নির্মিত হচ্ছে। এ সবই দেশের বঞ্চিত পোশাক শিল্পের শ্রমিক, বিদেশে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমরত শ্রমিক এবং কৃষিশ্রমিকদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রাব্যয়ে আমদানি করা গাড়ি। এটা হচ্ছে প্রধানত চলাচলের সুবিধার্থে। ব্যয়বহুল বিদেশী গাড়ির আমদানি এতটাই বেড়েছে যে, ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলো যানজটে নাকাল। রামপালে সুন্দরবন ও পরিবেশবিধ্বংসী মেগা-বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ ভারতীয় সাহায্যে চলছে। রাশিয়ারসাহায্যে রূপপুরে বিপজ্জনক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে।

এদিকে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপিত হবে। সরকারি অফিস আদালতগুলো ফুলেল সাজে সজ্জিত। বিদেশীদের আরাম-আয়েশ ও বিনোদনের জন্য কিছু বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল নির্মিত হয়েছে। বিদেশীদের পোশাকি সাধুবাদে সরকার এতটাই হৃষ্টচিত্ত যে, দেশের প্রকৃত অবস্থাবিবেচনায় না নিয়ে এবং দেশের লোকের বীতশ্রদ্ধার তোয়াক্কা না করে বিদেশীদের উন্নয়ন-সার্টিফিকেট লুফে নিচ্ছে। দেশে নগরকেন্দ্রিক বিদেশমুখী একটি বিত্তশালী ধনিকশ্রেণী গড়ে উঠেছে, যদিও প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে এদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। এই সরকারেরসর্বাবিধ সুযোগ-সুবিধা ও আনুকূল্য লাভ করছে। মোট কথা বাংলাদেশ ‘হ্যাজ গট বাটোন্ড ইটস্ কোট’; সুতরাং বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের সীমানা পেরিয়ে এখন ‘উন্নয়নশীল’ দেশে পরিণত।

পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ‘কারো সাথে বৈরিতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্ব’ নীতি অনুসরণ করছে। ভালো কথা। তবে মিয়ানমারের মতো দেশের সাথেও যদি এ নীতি অনুসৃত হয়, তবে তা হবে নির্বুদ্ধিতার কাজ। মিয়ানমার পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল চীনের সাথে নিবিড়সম্পর্ক রেখেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে ‘সকল দেশের স্বপ্রণোদিত বন্ধু’ বাংলাদেশকে নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে। তদুপরি রোহিঙ্গারা যখন অপমানিত, লাঞ্ছিত হয়ে এবং জানমাল খুইয়ে পথের নিদারুণ কষ্ট শিকার করে দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তখনও বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী চালকিনতে মিয়ানমার ছুটেছেন। ভারতকে খুশি রাখতে দেশের পররাষ্ট্রনীতির একমাত্র ব্যতিক্রম ‘পাকিস্তানের সাথে বৈরিতা’। সেই ভারত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা এবং আসাম থেকে এক কোটির অধিক মুসলমান বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে পৃথিবীর কোনো দেশখয়রাতি খাদ্য-পোশাক এবং ঔষধ সাহায্য ছাড়া সংশ্লিষ্টদেশের বিপক্ষে ও বাংলাদেশের পক্ষে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। রোহিঙ্গাসহ এসব ইস্যু চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিলো, বাগাড়ম্বর দায়িত্বশীল, আত্মমর্যাদাশীল ও কার্যকর পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলা যায় না।কথায় বলে- ‘ভাগের মা গঙা পায় না’। সরকার সবাইকে খুশি করতে গিয়ে কাউকে খুশি করতে পারেনি।

বর্তমান পাশ্চাত্য রীতিতে নতুন একটি স্লোগান উঠেছে- ‘মৌলবাদ, মৌলবাদ’; ‘জঙ্গিবাদ, জঙ্গিবাদ’। আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি মাহাথির মোহাম্মদ ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক আইন ডিগ্রি নিতে এলে সাংবাদিকেরা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কীমৌলবাদী’? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো মৌলবাদেই আছি’। মৌলবাদ সম্পর্কে তার অভিমত- ''I'm a fundamentalist in the true sense. That is to say, I follow the fundamentals of religion... But for over 1,400 years people have been interpreting and re-interpreting the religion to suit their own purpose! ... These [extremist and terrorist acts] are not Islamic fundamentals any more than the Christians who burned people at the stake are fundamentalist. They are actually deviating from the teachings of the religion!' (ইন্টারনেট)।

ইসলামের পবিত্র মূল নীতিগুলো যিনি মেনে চলেন, তিনিই মৌলবাদী। শান্তির ধর্ম ইসলামে এ নিয়ে হাঙ্গামার কিছু নেই। নবী করিম সা: পারলৌকিক ও ইহলৌকিক শান্তি বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যায় বলছেন, ‘আল্লাহ্ সঙ্গে শান্তির অর্থ- তাঁর ইচ্ছার প্রতি পরিপূর্ণভাবে নিজেকেসমর্পিত করা। মানুষের সঙ্গে শান্তির অর্থ- এমন জীবন যাপন করা যা কোনো মানুষের শান্তি বিনষ্টের কারণ না হয়’ (বোখারি ২/৩)। সুতরাং মৌলবাদে দোষের কিছু নেই যদি তা সততার সাথে অনুসৃত হয়।

জঙ্গিবাদ ইসলাম পছন্দ করে না। নবী করিম সা: তাঁর ওপর চাপিয়ে দেয়া ১৫/১৯টি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে ‘যুদ্ধকে ধোঁকাবাজি বলে নামকরণ করেছেন’ (বোখারি ৩৪/১১৮০)। তিনি এটাও বলেছেন- ‘যে ধোঁকাবাজি করে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়’ (মুসলিম)। এসত্য অনুধাবন না করেই অনেকে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ দুটোকে একত্রে গুলিয়ে তার স্বরে চেঁচামেচি করেন, ‘মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ সহ্য করা হবে না’। জঙ্গিবাদকে উৎখাত করতে গিয়ে তারা শান্তি ও নীতি-নৈতিকতার একটি উৎস ধর্মীয় মৌলবাদকেও নিরুৎসাহিত করেন। এ সবইঅমুসলিম ধনাঢ্য মুরব্বিদের সন্তুষ্ট করতে; ‘ইয়াহুদি, খ্রিষ্টান (ও পৌত্তলিকগণ) কখনো তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করো’ (সূরা : বাকারা ২, আয়াত ১২০)। নিজেদের ধন-সম্পদ ধনাঢ্য দেশে গচ্ছিত রেখে সৌদি আরবও পশ্চিমাদেশগুলোকে সন্তুষ্ট রাখতে নিজেদের চিরায়ত ইসলামি সামাজিক রীতিনীতি বদলে ফেলছে। আমরাও সে পথে অনেকদূর এগিয়েছি। তাই দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা যা-ই হোক না কেন, আজ আমরাও ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হিসেবে ‘উন্নত-বিশ্বের’ স্বীকৃতি পেলাম। 

  • Courtesy: নয়াদিগন্ত/৩১ মার্চ ২০১৮

No comments:

Post a Comment