Search

Wednesday, April 4, 2018

'ভোটের অধিকার না থাকলে আইনের শাসন থাকে না'



সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, দেশের মানুষ জীবনবাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের মালিক হিসেবে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে আইনের ব্যতয় ঘটছে সেখানে আমরা সবাই মিলে মিছিল করে তার প্রতিবাদ জানাতে পারি। মানুষের ভোটের অধিকার না থাকলে আইনের শাসন নিশ্চিত করা যায় না। আইনের শাসনের জন্য জনগণের ভোটের মাধ্যমেই সরকার নির্বাচিত করতে হবে। এজন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। 

মঙ্গলবার, এপ্রিল ৩, বিকেলে সংগঠনটি জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘আইনের শাসন: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ‘সুজন’-এর নির্বাহী সদস্য বিচারপতি আব্দুল মতিন।

এছাড়া গোলটেবিল বৈঠকে আলোচক হিসেবে ড. কামাল হোসেন, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম, ড. তোফায়েল আহমেদ, সৈয়দ আবুল মকসুদ, ড. আসিফ নজরুল, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থপতি মোবাশ্বার হাসান, গোলাম মর্তুজা, এএসএম আকরাম, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

মূল প্রবন্ধে বিচারপতি আব্দুল মতিন বলেন, আইনের শাসন বা ‘রুল অব ল’ প্রতিষ্ঠা আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতির জন্য অন্যতম অঙ্গীকার। যেমন, অঙ্গীকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে আমাদের সংবিধানই হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। তারই প্রস্তাবনায় আমাদের অঙ্গীকার এই যে, আমাদের রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হবে, সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।

বিচারপতি আব্দুল মতিন বলেন, ‘আজ জাতির জিজ্ঞাসা, আমরা কি আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার পালন করতে সক্ষম হয়েছি ? নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতন্ত্র বা অনুমতির গণতন্ত্র, অসীম ক্ষমতাধর নির্বাহী বিভাগ, ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে অকার্যকর আইনসভা এবং আপিল বিভাগের একটি রায়কে কেন্দ্র করে নির্বাহী বিভাগের তাণ্ডবে প্রকম্পিত বিচার বিভাগ কি প্রমাণ করে না যে, আমরা সে অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থ হয়েছি? ১১১ অনুচ্ছেদের ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও কুদরত-এ-এলাহী পনির মামলার রায় আজও অবহেলিত। মাজদার হোসেন মামলার নির্দেশনাগুলো এখনও অপ্রতিপালিত। ইদ্রিসুর রহমানের রায়ের নির্দেশনাবলি প্রবন্ধের শেষভাগে তিনি বলেন, ‘আজ নাগরিক সমাজ তথা সমগ্র জাতির একান্ত কর্তব্য সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে অঙ্গীকার আমরা করেছিলাম তার বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া। অন্যথায় আমরা অঙ্গীকার ভঙ্গকারী জাতি হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে বাধ্য।’

ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশের মানুষ জীবনবাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা সংবিধানে সেটা স্বীকার করেছি। ৪৭ বছর পরেও আমাদের সংবিধান বহাল আছে। এ দেশের মালিক জনগণ--এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ষোড়শ সংবিধান ৭ জন বিচারপতি বাতিল করেছেন। আমরা সবাই বলেছি যে, এটা অসাংবিধানিক। তাই আমার মনে হয় না যে, রিভিউর মাধ্যমে এটা বাতিল করা যাবে। এই সংশোধনী বাতিল করার ক্ষেত্রে বিচারকদের ভ’মিকা অস্বীকার করা যাবে না। স্বাধীন দেশের বিচারককে প্রকাশ্যে তুই তুকারি করা দেশের প্রতিটি মানুষকে অপমান করার শামিল।

তিনি বলেন, যেসব ক্ষেত্রে আইনের ব্যতয় ঘটছে সেখানে আমরা সবাই মিলে মিছিল করে তার প্রতিবাদ জানাতে পারি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের মালিক হিসেবে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলি, তাদেরকে অধিকার সচেতন ও সোচ্চার করে তুলি।

তিনি বলেন, আইনের শাসনের জন্য জনগণের ভোটের মাধ্যমেই সরকার নির্বাচিত করতে হবে। এজন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা করি। 

ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম বলেন, ‘আইনের শাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জনগণের সামনে আমরা কি বিষয়গুলো উত্থাপন করছি সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যম দ্বারা অনুমোদিত কিনা তাও গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান অনুধাবন করার মত করা উপযুক্ত নাগরিক আমরা নাগরিক তৈরি করতে পারছি কিনা তাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বলেন, বিচারক নিয়োগে আইন করার জন্য আমরা স্বাধীনতার প্রারম্ভে পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। কিন্তু ৪৭ বছর পরও আমরা তা করতে পারিনি। ষোড়শ সংশোধনী মামলায়ও আমি এই বিষয়ে জোর দিয়েছিলাম। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রশাসন ও বিচার বিভাগসহ অনেক ক্ষেত্রেই নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই।

চাকরিতে কোটা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নয়। তাই কোটার মাধ্যমে তাদের সন্তানদের চাকরিতে নিয়োগ দেয়া তাদের প্রতি অসম্মান করার সমান। 

বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বলেন, আইনের শাসন মানে জনগণের সম্মতির শাসন। আইন হতে হলে তাতে জনগণের সম্মতি থাকা লাগবে এবং আইন হতে হলে তা বিচারকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

ড. আসিফ নজরুল বলেন, আইন প্রণীত হতে হবে জনগণের ভোটে প্রকৃত প্রতিনিধি দ্বারা। এটা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন সঠিক হতে হবে। যে কারণে আমরা সামরিক শাসনের আইনকে আমরা আইন হিসেবে সাধারণত মেনে নেই না। আর আইন কারো ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে, কারো ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে না তা আমরা মেনে নিতে পারি না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আইনের শাসনের মাহাত্ম হলো সাধারণ মানুষ থাকবে স্বস্তিতে এবং অপরাধীরা থাকবে। এমনকি রাষ্ট্রের সবচেয়ে দুর্বলতম ব্যক্তিটিও নিরাপদ থাকবে। একটি রাষ্ট্রে কম গণতন্ত্র মানা যায়, কিন্তু আইনের শাসনের ব্যতয় আমরা মেনে নিতে পারি না। আইনের শাসনের ব্যতয় ঘটছে কি-না তা তারাই বলতে পারবেন যারা গুম-খুনের শিকার হচ্ছেন।

ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, চাকরিতে কোটা সংবিধান সম্মত। কিন্তু সবার জন্য এ কোটা প্রযোজ্য হবে না, কোটা হলো অনগ্রসর শ্রেণির জন্য। বর্তমানে যারা কোটার সুযোগ নিচ্ছেন তাদের সবাই কোটার যোগ্য নয়। যে কোনো অর্ডার আইনসম্মত হতে হয়। কিন্তু আমরা বর্তমানে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইন নয়, বরং অর্ডারের অধীনে রয়েছি।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ প্রধান ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বিচার বিভাগের সাথে অন্য বিভাগগুলোকে সমান্তরালে এগিয়ে যেতে হবে। আমি মনে করি, মানুষের ভোটের অধিকার না থাকলে আইনের শাসন নিশ্চিত করা যায় না। তিনি বলেন, একজন প্রধান বিচারপতি হঠাৎ করে দুর্নীতিবাজ হয়ে গেলেন। কিন্তু তার বিচার কেন হলো না কেন? তিনি যে দুর্নীতি করেছেন তার সাথে কারা যুক্ত ছিলেন তাও আমরা জানতে চাই। আদালতের ব্যাপারে আমরা আস্থা হারাতে চাই না। কিন্তু জনগণের সম্মতির শাসন চাই, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাই।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আইনের শাসন ছাড়া যে শাসন তা সভ্য শাসন নয়। বিচারপতিদের নিয়োগে আইন পাশ করার দাবি জানান তিনি।

অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশে আইনের শাসন নেই। বরং দেশে আছে দুঃশাসন ও অপশাসন। আজকে একটা মহল দেশের ইচ্ছামত দেশ পরিচালনা করছে। আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ব্যবসা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় দেশকে রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। 

সৌজন্যে - নয়াদিগন্ত/ এপ্রিল ৩, ২০১৮। 

No comments:

Post a Comment