খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকা
নাসরিন আক্তার
খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রায় দুই একর নিচু জমি ভরাট করছে প্রভাবশালীরা। অধিদপ্তর রামপুরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে। কিন্তু দখলের কাজ থেমে নেই। রাতের বেলায় ট্রাকে করে মাটি এনে ফেলা হচ্ছে ওই জমিতে।
গণপূর্ত বিভাগ-৪ প্রথম আলোকে জানায়, খিলগাঁও এলাকার নিচু জায়গাটি গণপূর্ত বিভাগের মালিকানাধীন। খিলগাঁও মাটির মসজিদ–সংলগ্ন ওয়াসার ৭ নম্বর পানির পাম্পের পাশের এই নিচু জমি এক মাসের বেশি সময় ধরে মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। জায়গার পাশে মাইলস্টোন হোমস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডও টাঙানো আছে।
এই সূত্রে ৭ মার্চ সরেজমিনে দেখা যায়, মাইলস্টোন মিম টাওয়ারের সাইনবোর্ডে ৭২ জন সম্ভাব্য ফ্ল্যাট মালিকের নামের তালিকা দেওয়া আছে। তালিকায় প্রথমে নাম আবু জাফর মো. সালেহ নামের এক ব্যক্তির। এরপর যথাক্রমে আছেন মো. মসিয়ার রহমান, এস এম আল হেলাল, মো. অলিউল্লাহ, রায়হানা বিনতে জহির, মো. দেলোয়ার হোসেন, মোসা. মৌসুমীসহ ৭২ জন। তাঁদের কারও পরিচয় জানা যায়নি।
সর্বশেষ ২৮ মার্চ আবার সরেজমিনে দেখা যায়, সাইনবোর্ডটি নেই; সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ জমি ভরাট করা হয়েছে। ভরাট করা জায়গা টিন দিয়ে ঘিরেও দেওয়া হয়েছে। সাইদুর রহমান নামের এক ব্যক্তি সেখানে ভরাটকারীদের পক্ষে দেখাশোনার কাজ করছেন। কারা জায়গা ভরাট করছে, তিনি বলতে রাজি হননি।
ঝিলের আশপাশের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাটি ভরাটের আগে এই ঝিলের ওপর বাঁশ ও টিনের ঘর করে ভাড়া দিয়ে রেখেছিলেন আতিক, বাবু, জয় ও মিজান (মৃত) নামের পাঁচজন। অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির জন্য মাটি ফেলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এসব বাড়িতে ভাড়া থাকা মানুষদের সরিয়ে দেওয়া হয়।
ঝিল ভরাটের বিষয়ে জানতে পেরে গত সপ্তাহে রামপুরা থানায় জিডি করে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ। সাধারণ ডায়েরির অনুলিপি, জায়গার নকশা এবং সাইনবোর্ডের ছবিসহ ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল ২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার বরাবর চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয়েছে, ঢাকাস্থ খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকার প্লট নং বি/২১৮, বি/২১৯, বি/২২০, বি/২২১, বি/২২২ এর পেছনে, শহর খিলগাঁও মৌজার সি এস দাগ নম্বর ২৫৪, ২৫৫, ২৫৬, ২৫৭ ও ২৫৮–এর প্রায় দুই একর সরকারি ঝিলের জমিতে জনৈক আবু জাফর মো. সালেহ গংসহ ৭২ জন ‘নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট মালিকগণের নাম’ শিরোনামে একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করেছেন। জনৈক আবু জাফর মো. সালেহ গং সরকারি জমিতে বিনা অনুমতিতে অবৈধভাবে মাটি ভরাট করছেন। গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী সরেজমিনে ঝিল ভরাট করতে নিষেধ করে এসেছেন। এরপরও ঝিল ভরাট চলছে।
জানা যায়, ১৯৬১ সালের দিকে কমলাপুরে রেলওয়ে স্টেশন এবং রেললাইন নির্মাণের জন্য সরকার জায়গা অধিগ্রহণ করে। ঝিল থেকে মাটি খনন করে আশপাশের ভূমি উন্নয়ন করা হয়। তখন খিলগাঁও এলাকার নিচু জমিতে কমলাপুরে অধিগ্রহণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ জন্য এটি খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকা নামে পরিচিত।
এই ঝিল ভরাট বন্ধে গত সপ্তাহে এলাকার ২৯ জন বাড়ির মালিক স্বনামে স্বাক্ষর করে একটি চিঠি গণপূর্ত অধিদপ্তর সার্কেল-৪ এ জমা দেন। এতে বলা হয়েছে, তাঁরা খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকায় বরাদ্দকৃত প্লটের মালিক। ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে আছেন। বর্ষাকালে এই এলাকার পানি ঝিল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রামপুরা এলাকা দিয়ে সরে যায়। এই ঝিল ভরাট হলে আগামী বর্ষায় পানি জমে এলাকায় মারাত্মক জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে জনদুর্ভোগ বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে। চিঠিতে বলা হয়, ইতিমধ্যে ঝিল ভরাট শুরু করায় আশপাশের বাড়ির নিচতলায় ঝিলের পানি ঢুকে পড়েছে। কয়েকটি বাড়ির নিচতলার ভাড়াটেরা বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন।
ওই স্বাক্ষরকারীদের কয়েকজন প্রথম আলোকে বলেন, মাটি ভরাট করতে প্রথমে তাঁরা আপত্তি জানান, এখন গণপূর্ত জিডি করেছে। তারপরও ভরাট বন্ধ নেই; বরং রাতের বেলায় মাটির ট্রাক, বুলডোজারের শব্দ, মাটি ভরাটকারী শ্রমিকদের হট্টগোলে এলাকাবাসীর দুর্ভোগ বেড়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসির) ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোস্তাক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় এক বাসিন্দার অভিযোগের পর ঝিলে মাটি ভরাটের বিষয়টি তিনি জেনেছেন। তারপর খোঁজখবর করে জানতে পারেন, ঝিলে মাটি ভরাটের সঙ্গে জমির ভুয়া দলিল তৈরিকারী হিসেবে পরিচিত আলী মনসুর জড়িত। এর সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) এক ওয়ার্ড যুবলীগের নেতার জড়িত থাকার কথাও শুনেছেন তিনি। তবে অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা জানিয়েছেন, তিনি ঝিল ভরাটের বিষয়ে কিছু জানেন না।
এ বিষয়ে রামপুরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ঝিল ভরাটের বিষয়ে তদন্ত করছি। বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। পুলিশ যাওয়ার খবর পেয়ে মাটি ভরাটকারীরা পালিয়ে গেছে। তবে জিডিতে নাম থাকা আবু জাফর মো. সালেহকে তার লোক দিয়ে ডেকে এনে ডিজির কপি রিসিভ করিয়েছি। তাকে ঝিল ভরাট বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি।’
আবু জাফর মো. সালেহ দাবি করেছেন, এই জমির দলিল তাঁর আছে। তিনি জায়গার মালিক।
কামরুল ইসলাম বলেন, অবৈধ ভরাট নিয়ে গণপূর্ত বিভাগ থেকে মামলা করা হলে পুলিশ সব সহযোগিতা করবে। ভূমিদস্যুদের কোনো ছাড় নেই।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের সার্কেল ৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী স্বর্ণেন্দু শেখর মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা করার জন্য জড়িতদের নাম সংগ্রহ করছি। বিলবোর্ডে যে ৭২ জনের নাম পেয়েছি, সেসব নাম ধরে আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
- Courtesy: Prothom Alo/ Apr 01, 2018
No comments:
Post a Comment