সানেমের অর্থনীতি পর্যালোচনা
- বিপুল খেলাপি ঋণ, উচ্চ সুদহার, খারাপ আর্থিক অবস্থা-এসব কারণে ক্ষতির হার জিডিপির ১ শতাংশ।
- ব্যাংকের এই অদক্ষতার প্রায় পুরোটাই দুর্নীতি ও অনিয়ম থেকে উৎসারিত
গতকাল রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির ত্রৈমাসিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করে সানেম। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান।
সানেমের তথ্যমতে, ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকট অনেক দিন ধরে চলমান কাঠামোগত সমস্যারই ফল। এ খাতে অত্যধিক মাত্রায় অনাদায়ী ঋণ রয়েছে, বর্তমানে যা ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। একের পর এক কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকিং খাতের প্রতি অনেক মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বেসরকারি ব্যাংকের অত্যধিক মাত্রায় ঋণ বিতরণের ফলে এডি রেশিও ৯০ ভাগের উপরে দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংকঋণের একটা বড় অংশ অপচয় হচ্ছে জানিয়ে সানেম বলেছে, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ ব্যাংকিং খাতের একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটে যাওয়া অনিয়মের কোনো দৃশ্যমান শাস্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় এ সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সিআরআর কমিয়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আনার ফলে ব্যাংকিং খাতে একটি বড় সংকট সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করে সানেম।
অনুষ্ঠানে সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বিরাজমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতের সংকট আরো প্রকট হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই আমরা চাই না। ব্যাংকিং খাতের এ পরিস্থিতি যাচাইয়ে সবচেয়ে দৃশ্যমান সূচক নন-পারফর্মিং লোন। এক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যাংক যে ভালো করছে না তা বলা যাবে না, তবে খারাপ পারফরমারদের কারণে ভালো পারফরমারদেরও চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে। বর্তমানে সিআরআর কমাতে যে ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা যদি সঠিকও হয়, এ সিদ্ধান্তের পদ্ধতি যথাযথ নয় বলে আমরা মনে করছি। আমরা এমন কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আশা করছি, যার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম হলেও তার প্রভাব যেন বড় সমস্যা সৃষ্টি না করে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রসঙ্গেও পর্যালোচনা দিয়েছে সানেম। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বাংলাদেশ ২০১৮ সালের মার্চে প্রথম পর্যালোচনায় স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের তিনটি শর্ত সফলভাবে পূরণ করেছে। আশা করা যায়, ২০২১ সালের দ্বিতীয় পর্যালোচনায়ও বাংলাদেশ এ শর্তগুলো পূরণ করে ২০২৪ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। তবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে দেশের ভাবমূর্তিতে ইতিবাচক পরিবর্তন যেমন আসবে, তেমনি কিছু আশঙ্কার কারণও রয়েছে। তা হলো, ২০২৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও চীনের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রবেশের সুবিধা হারাবে। এর ফলে দেশের মোট রফতানি ১১ শতাংশ কমে যাবে, যা রফতানি প্রবৃদ্ধির বর্তমান প্রক্ষেপণের সাপেক্ষে ৬ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য হতে পারে।
এ অবস্থায় সক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আগামী নয় বছরে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে জানিয়ে সানেম বলেছে, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের পরিবেশ না থাকা, বর্ধিত রফতানি হার না থাকা, প্রতিযোগিতামূলক বাজারের অনুপস্থিতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো যথেষ্ট মজবুত না থাকাটা আমাদের এখনকার সমস্যা। এগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। দেশে বৃহৎ পরিসরে বিদেশী বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পণ্য রফতানিতে উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য আনতে হবে, প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করতে হবে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো সুদৃঢ় করতে হবে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বস্তুনিষ্ঠ সেবা টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত।
পূর্ববর্তী বাজেটের অভিজ্ঞতার আলোকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের চ্যালেঞ্জ নিয়েও গতকাল পর্যালোচনা দিয়েছে সানেম। তাদের মতে, প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো— আয়তন প্রক্রিয়ায় দুর্বল কর্মদক্ষতা, এডিপি বাস্তবায়নে ঘাটতি, জনস্বাস্থ্যের মান এবং মানব উন্নয়নে স্বল্প ব্যয়।
গতকালের এ অর্থনীতি পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে সানেমের চেয়ারম্যান ড. বজলুল হক খন্দকার, ফেলো ড. ফরাজী বিনতে ফেরদৌস, ড. সায়েমা হক বিদিশা ও প্রতিষ্ঠানটির গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।
- Courtesy: Banikbarta/ Apr 05, 2018
No comments:
Post a Comment