ফাইজ তাইয়েব আহমেদ
বোধ ও বিবেকসম্পন্ন একটি স্বাধীন সমাজে অনির্দিষ্টকালের জন্য মেধা ও যোগ্যতার বিপরীতে মেধাহীন পঙ্গুত্ব তৈরির ‘কোটা ব্যবস্থা’ নামক প্রণোদনা চলতে পারে না । দেশ এখন স্বাধীনতার ৪৮তম বছরে পদার্পণ করতে চলেছে।
৫৬ শতাংশ কোটা কয়েক হাজার তরুণের জন্য সংরক্ষিত রেখে (যেখানেও আবার তদবির, ঘুষ ও দুর্নীতির যোগ রয়েছে) বাকি লাখ লাখ তরুণকে ৪৪ শতাংশের জন্য প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়াকে পদে পদে বিভেদসৃষ্টিকারী অন্যায্য রাষ্ট্রীয় আচরণেরই দর্পণ। কোটাধারীরা স্বল্প কিংবা অতি নিম্ন মেধাবী হয়েও সরকারি চাকরিতে এসে রাষ্ট্র পরিকল্পনা ও পরিচালনার দূরদর্শিতাকে বিষিয়ে দিচ্ছে। একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা ও অগ্রসর নাগরিকের দেশত্যাগে সৃষ্ট শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে একদল অযোগ্য, চাটুকার ও অসৎ লোকে ভরে গেছে বাংলাদেশের লোকপ্রশাসন। ৪৭টি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এ হীনতাকে বছর বছর মজবুতই করা হয়েছে, ফলে কোটা খেয়ে ফেলেছে মোট সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ!
কথা হচ্ছে, দেশের পশ্চাতপদ লোকালয়গুলোকে, প্রাকৃতিক কারণে পিছিয়ে পড়া নাগরিককে রাষ্ট্র কীভাবে সুরক্ষা দেবে? হ্যাঁ, সেখানে কিছু টাইম ডিফাইন্ড অতি সীমিত কোটা থাকতে পারে। এ সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রকে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে অর্থনীতি সচল করার এবং কর্মসংস্থান তৈরির স্থায়ী কাঠামো তৈরি করতে হবে। পিছিয়ে পড়া নাগরিককে অক্ষম না ভেবে তার বিশেষ স্কিল তৈরির বিশেষ স্কুল তৈরি করতে হবে, তাকেও তার সীমিত সক্ষমতার আলোকে সরকারি ও বেসরকারি সব ক্ষেত্রের চাকরি বণ্টনে আনার চর্চা তৈরি করতে হবে, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সমাজে দৃষ্টি, বুদ্ধি কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধীর মানবিক মর্যাদা তৈরির স্পেস তৈরি করতে হবে। তবে স্বাধীন দেশের জন্ম অবধি পুরো ৪৭ বছর ধরে পশ্চাত্পদতার কথা বলে কোটা চলতে থাকলে বুঝতে হবে রাষ্ট্র আসলে এ পিছিয়ে পড়া অঞ্চল বা নাগরিককে বোধগম্য সুরক্ষা দিয়ে কার্যকর কাঠামো তৈরি করতে হয় নির্লিপ্ত অথবা অক্ষম কিংবা এ ব্যাপারটা ডিল করার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তার নেই। বরং কোটা ব্যবস্থাকে এক্সপ্লয়েট করে সে দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক প্রশাসনকে লুটের যোগে ব্যতিব্যস্ত রাখতেই সক্রিয়।
একজন কোটা সংস্কার অ্যাক্টিভিস্ট লিখেছেন, ‘কোটা পৃথিবীর সব দেশেই বিদ্যমান, তবে কোথাও চিরস্থায়ী নয়। কোটা সাধারণত হয় ১০-১৫ বছরের জন্য সমাজে পিছিয়ে পড়া বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য, যেমন— ভারতে ১৫ বছরের জন্য দলিত সম্প্রদায়ের কোটা এখন বিদ্যমান, যুক্তরাষ্ট্রে মোট ১০ বছর রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য ২ শতাংশ কোটা বিদ্যমান ছিল। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো দেশেই ১৫ শতাংশের ওপর কোটা বিদ্যমান নেই, যেখানে আমাদের দেশে ৫৬ শতাংশই কোটায় চলে যায়, যা ৪৮ বছর ধরে চলমান! ভাবা যায়?’
অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নামে আরেক জালিয়াতি শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে মুক্তি সনদ এবং মুক্তি কোটার চূড়ান্ত অপপ্রয়োগ। অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৈষম্যে ভোগা দেশকে একদল মুক্তিসেনা মেধাহীন প্রশাসন দিয়ে রিপ্লেস করতে স্বাধীন করেননি, ৪৭ বছর পরও যদি এ বোধ না জন্মায়, তবে স্বাধীনতা অকার্যকর। মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্মান দিয়ে সম্মানিত করতে হবে, দ্বিতীয় কোনো পন্থায় নয়। হ্যাঁ অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য প্রয়োজন মাফিক আর্থিক সহায়তা দেয়াকে কার্যকর করা একটি বিকল্প, তাও এটা চূড়ান্তভাবে সাধারণ নাগরিকের সুরক্ষা হীনতাকেই (পেনশন কিংবা রেশন কিংবা মানসম্পন্ন বয়স্ক ভাতা ইত্যাদির অনুপস্থিতিকে) নির্দেশ করে। নাতি-পুতিকে কোটায় চাকরি দেয়া কোনো মতেই বিকল্প হতে পারে না। এ দুর্বৃত্তপনার অবসান চাই।
যদি ধরে নিই, বাংলাদেশে প্রতি বছর আনুমানিক ১৭-২০ লাখ চাকরি প্রার্থী শ্রমবাজারে উন্মুক্ত হচ্ছেন (পাস করা, ঝরে পড়া, ফেল করা, পিছিয়ে পড়া সবাই মিলে)। এ অতি উচ্চ সংখ্যার বিপরীতে বাংলাদেশ সরকার অনূর্ধ্ব ৩৫ হাজার নাগরিককে বছরে চাকরি দিচ্ছে (যদিও এ সংখ্যা অতি বর্ধিত)। অর্থাৎ সরকার বার্ষিক মোট প্রয়োজন ১৭ লাখের মাত্র ২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশের নিয়োগ দাতা। বাকি নাগরিক যাচ্ছে কোথায়? বেসরকারি খাত, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত কিংবা কৃষিতে! বুঝতে পারছেন! একটি অক্ষম সরকারি নিয়োগ যন্ত্রের বিপরীতে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত ও কৃষি কী পরিমাণ সক্ষম!কিংবা কী পরিমাণ নাগরিক বছর বছরবেকারত্বের বোঝা নিয়ে শুধু হাঁটছেন?
২০১৮ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ২০ লাখ ৩১ হাজার ৮৮৯ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্যে ১০ লাখ ২৩ হাজার ২১২ জন ছাত্র ও ১০ লাখ ৮ হাজার ৬৮৭ জন ছাত্রী রয়েছে। (এসএসসিতে ১৬ লাখ ২৭ হাজার ৩৭৮ জন, মাদ্রাসা বোর্ডের অধীন ২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৫২ জন এবং কারিগরিতে ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৬৯ জন, এছাড়া বিদেশে ৪৫৮ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছে)। ২০১৭ সালে এসএসসি ওসমমানের পরীক্ষায় মোট ১৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬১৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। গত বছরের চেয়ে এবার পরীক্ষার্থী বেড়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ২৮৬ জন।
ধারণা করা হয়, বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ৬০ লাখের অধিক শিক্ষিত যুবক আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মহীন। জরিপ বলছে, প্রায় ৪৭ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত যুবক বেকার।
বাংলাদেশের শ্রমঘন বেসরকারি শিল্প ও গার্মেন্টস খাতে কর্মঘণ্টা অতি দীর্ঘ, কাজের পরিবেশ নাজুক, ছুটি নেই। নেই ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স। নেই বার্ষিক ছুটি, স্বাস্থ্য বীমা কিংবা অবকাশ ভাতা। নেই ট্রান্সপোর্টেশন ভাতা কিংবা সন্তানের শিক্ষা ভাতা, নেই আবাসন ফ্যাসিলিটি। কর্মহীন যুবকের দীর্ঘ চাকরি খোঁজার ক্লান্তি, সেটা যাচাইয়ের প্রতীক্ষা করে না, সে শুধু এন্ট্রান্স চায়। চায় শর্তহীন জব অ্যাকসেস। ছয়টি ওপেনিংয়ের বিপরীতে পড়ে ৮৬ হাজার আবেদনপত্র, চাকরি তাই সোনার হরিণ। ১৫ শতাংশ শিল্প শ্রমিক বস্তিবাসী, অফিস ট্রান্সপোর্টেশন পদযুগল। বেসরকারি স্কিল্ড ও সেমিস্কিল্ড জব মাত্রই অন্যূন ১২-১৪-১৬ ঘণ্টা ডিউটি। বিস্তৃত নিম্নমধ্যবৃত্তের আবাসন ঘিঞ্জিঘর।
তাই মেধাবী তরুণের উপলব্ধির পরিধিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। আজকের তরুণ রাষ্ট্রের সঙ্গে কী কী বোঝাপড়া চায় এবং কী কী দাবি তার করা উচিত, তাকে বোধগম্য ও সংজ্ঞায়িত করা জরুরি। শুধু ২দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ চাকরিদাতার মেধার মূল্যায়ন নাকি বাকি বিশাল ওয়ার্ক স্পেসে মানসম্পন্ন কাজের পরিবেশ ও কাজের ফ্যাসিলিটির নিশ্চয়তা। সে কি ন্যূনতম বেতন চাইবে নাকি নগরে বাঁচার উপযোগী পারিশ্রমিক দাবি করবে। সর্বোচ্চ ১০ কর্মঘণ্টার মানবিক শ্রমজীবনের বাধ্যবাধকতা দাবি তোলাও চাই। অমানবিক শ্রমঘণ্টার অবসান বেসরকারি খাতে অন্তত ২৫ শতাংশ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে— সে উপলব্ধির জমিন তৈরিকরতে হবে তাকে, শুধু বিসিএস কোটা আন্দোলনে এলে বিস্তৃত কোনো প্রাপ্তি নেই।
প্রতিভাবান ও সম্ভাব্য তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য অনুকূল ব্যাংকিং প্রভিশন, প্রশাসনিক রেজিস্ট্রেশনের ঝামেলাহীন ওয়ানস্টপ পয়েন্ট, সহজ আয়কর পেপার ওয়ার্কস, চাঁদাবাজি ও ঘুষ মুক্ত ব্যবসা শুরুর অনুকূল অবকাঠামো তৈরির উপাদানগুলো তরুণদের আন্দোলনের নেগোসশিয়েশন পয়েন্ট হিসেবে আনতে হবে। একজন উদ্যমী তরুণ কেন একজন উদোক্তা হয়ে উঠতে পারছেন না, তার সব অবকাঠামোগত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধাগুলো চিহ্নিত করে এর বিপরীতে কৌশলগত কর্মসূচি প্রণয়নই আজ ও আগামীর প্রধান দাবি হওয়া চাই।
আজকের তরুণকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে হবে কেন স্থানীয় রিসোর্স (এক্সপার্ট) থাকা সত্ত্বেও ম্যানেজমেন্টের পদে, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা প্রোডাকশন ফ্লোরে গণহারে বিদেশী নিয়োগ হচ্ছে? কেন বিদেশী ওপেনিংয়ের প্রাকপর্যায়ে স্থানীয় লোকবলের সক্ষমতা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া মানা হয় না? স্থানীয় স্কিল তৈরির ব্যবসায়িক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কিংবা প্রকৌশল অবকাঠামো ও ইন্টারফেসগুলো তৈরি কেন হচ্ছে না।
অর্থাৎ দেশে কর্মসংস্থানকে টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদের জন্য স্থিতিশীল করতে তরুণকে দূরদর্শিতা নিয়ে ভাবনায় বসতে হবে এবং এ উপলব্ধিগুলোকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। নাগরিকবান্ধব, জনস্বার্থ অনুকূল কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাকে সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে।
তাহলে কি তরুণরা কোটাপ্রথা মুক্তির আন্দোলন করবে না? অবশ্যই করবে। বরং সফল হতে হলে আন্দোলনকে এ রকমই ন্যারো স্কোপে রেখে দাবি আদায়ের নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে অবিরত। একধাপের সাফল্যকে পরবর্তী ধাপে উত্তরণ করে কৌশলগতভাবে নতুন আন্দোলন শুরু করতে হবে। চূড়ান্ত ও টেকসই কর্মসংস্থানের অবকাঠামো তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এ প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় শুধুকোটা আন্দোলন আদতে কর্মসংস্থান তৈরির বড় কোনো পরিসরই তৈরি করতে পারবে না। কারণ মোট কর্মসংস্থান চাহিদার বিপরীতে চাকরিদাতা হিসেবে সরকারি খাত নিতান্তই নগণ্য, গৌণ। সরকারকে বেসরকারি খাতে মানবিক শ্রম ও বাঁচার উপযোগী মজুরি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করাতে হবে, আইডিয়া নিয়ে রাস্তায় ঘোরা উদ্যমী তরুণকে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাংকিং ও প্রশাসনিক প্রসেস বাস্তবায়নে বাধ্য করাতে হবে।তবেই চূড়ান্ত ও কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসবে, যা উন্নত জীবনমান ও ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স হিসেবে বাস্তব রূপ পাবে।
তরুণদের আজকের আন্দোলনের ভিত টেকসই ও ভবিষ্যত্মুখী হয়ে উঠুক, মানসম্পন্ন চাকরি ও ন্যূনতম চাকরি সুবিধাদি আদায়ের বোধ এবং প্রত্যয় গড়ে উঠুক। তারুণ্য এগিয়ে যাক। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা রাষ্ট্রের স্তরে স্তরে সঞ্চারিত হোক। মেধা ব্যবস্থাপনা সেন্সিবল হোক। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক!
- লেখক: সিনিয়র সফটওয়্যার সলিউশন আর্কিটেক্ট, ভোডাফোন নেদারল্যান্ডস। faiz.taiyeb@gmail.com
No comments:
Post a Comment